রাজনীতি, দৈনিক সারা দুনিয়া নিউজ ডেস্ক।
শিক্ষার্থীদের নতুন দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র আত্মপ্রকাশ ঘটল শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি)। এদিন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
বক্তব্যের শেষে তিনি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি দেন। শুধু তিনিই নন; নতুন দলটির প্রায় সব শীর্ষ নেতা বক্তব্যের ইতি টেনেছেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি দিয়ে।
মূলত: শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার সময় থেকেই ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি বেশি শোনা গেছে ছাত্র-জনতার মুখে। সে সময় থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় স্লোগানটি বেশি ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
প্রশ্ন জেগেছে, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ – বলে নতুন এই দলটি কী বলতে চেয়েছে কিংবা ভবিষ্যতে কী করতে চাইছে? তাছাড়া অন্য ভাষার এই স্লোগান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হলো কী করে? কোথা থেকে এলো এই স্লোগান?
জানা যায়, ‘ব্রিটিশ ভাগাও’ আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়েছে এই স্লোগান। যে কারণে কৌতূহল তৈরি হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান কি তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি দলীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেছে!
‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র আত্মপ্রকাশের দিনে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেন দলটির শীর্ষ নেতারা
এসব প্রশ্নে জবাব জানতে হলে প্রথমে স্লোগানটির শাব্দিক অর্থ জানা দরকার।
ইনকিলাব শব্দটি এসেছে মূলত আরবি ইকলাব শব্দ থেকে। যার অর্থ পরিবর্তন। আর জিন্দাবাদ শব্দটি উর্দু ও ফারসি ভাষার মিশেল। যার অর্থ অভিনন্দন জানানো। অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় পরিবর্তনকে অভিনন্দন জানানো। ইনকিলাব তথা পরিবর্তনকে বিপ্লব অর্থেও বোঝানো হয়। সে হিসেবে ইনকিলাব জিন্দাবাদ মানে বিপ্লবকে অভিনন্দন জানানো।
তবে প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব ইনকিলাব জিন্দাবাদের অর্থ করেছেন, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। মূলত এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে স্লোগানটি। ২০২২ সালের ২৯ মে ভারতীয় পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এক লেখায় স্লোগানটির উদ্ভব, উদ্ভাবক ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন তিনি।
ইরফান হাবিব লিখেছেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয় মাওলানা হাসরাত মোহানির কণ্ঠে। ১৯২১ সালে প্রথম স্লোগানটি ব্যবহার করেন। ব্রিটিশ শাসনে ভারতবর্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি দিয়েছিলেন হাসরাত মোহানি। এরপর এ স্লোগান উপনিবেশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা ভগত সিংয়ের কণ্ঠেও বারংবার উচ্চারিত হয়েছে। সে সময় প্রতিরোধ, বিপ্লব এবং ন্যায়বিচারের কালজয়ী প্রতীক হয়ে ওঠে স্লোগানটি।
হাসরাত মোহানির বিষয়ে জানা গেছে, বহুমুখী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। প্রথমত উর্দু ভাষার একজন কবি ছিলেন হাসরাত। তবে কাব্য-কবিতার জগৎ ছাপিয়ে তার পরিচিতির ব্যাপ্তি অনেক। তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ, ছিলেন শ্রমিকনেতা। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও তিনি।
ইরফান হাবিব লিখেছেন, হাসরাত মোহানি ভারতের উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলার মোহন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হয় ফজলুল হাসান। এ নামেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ‘হাসরাত’ ছদ্মনামে বিপ্লবী উর্দু কবিতা লিখতেন তিনি। পরে এ নামেই রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতার সঙ্গে প্রথম ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজ (পূর্ণ স্বাধীনতা) দাবি উত্থাপন করেছিলেন হাসরাত। ১৯২১ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে তিনি সে দাবি করেছিলেন।
হাসরাত মোহানির এ বিপ্লবের ডাক মূলত আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত একটি পৃথিবীর কল্পনা করেছিলেন। এ বিপ্লবী কবির কাছে বিপ্লব কেবল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের বিষয় ছিল না বরং নিপীড়নের ব্যবস্থা ভেঙে একটি ন্যায়সংগত সমাজ গঠনই ছিল তার অধ্যবসায়।
হাসরাত মোহানি এই স্লোগানের স্রষ্টা হলেও ভগত সিং এবং হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের তার সহকর্মীদের প্রচেষ্টায় এটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ভগত সিং-এর কাছে বিপ্লব কেবল ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার জন্য ছিল না; এটি ছিল সমাজকে রূপান্তর করার জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বিপ্লব বোমা এবং পিস্তলের সংস্কৃতি নয়... আমাদের বিপ্লবের অর্থ হল প্রকাশ্য অবিচারের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন। ’ভগত সিং, রাম প্রসাদ বিসমিল এবং আশফাকুল্লাহ খানের মতো বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের সঙ্গে মিলে এই স্লোগান প্রতিরোধের এক শক্তিশালী প্রতীক হয়ে ওঠে। এটা কেবল স্বাধীনতার আহ্বান ছিল না পাশাপাশি শ্রেণিগত বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং শোষণমুক্ত সমাজের জন্য একটি দর্শন ছিল।
ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত, এই স্লোগান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যা স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজ সংস্কারক এবং বিপ্লবীদের বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করেছে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের সময় স্লোগানটি নতুন করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ সময়টি ছিল এমন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত যখন ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারণ নাগরিকরা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পতনের জন্য ঐকমত্য হয়েছিল। জুলাই বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ এই ইনকিলাব জিন্দাবাদ, প্রতিরোধের ভাষা। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতনের দেয়ালে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের কুঠারাঘাত প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান ব্যবহারের বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রবল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষ জেগে উঠেছিলো। সে জায়গা থেকেই স্লোগানটি এসেছে। তবে আমাদের দলীয় স্লোগান, গঠনতন্ত্র, কর্মসূচি ও পতাকা আমরা এখনো চূড়ান্ত করিনি। সূত্র: এফবি।