স্বাস্থ্য বার্তা, দৈনিক সারা দুনিয়া।
এমপক্স রোগটি সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত জানেন না অনেকেই।এমপক্স নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
এমপক্স কী, কীভাবে ছড়ায়, এর লক্ষণসহ বিস্তারিত জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স কী
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এমপক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ। বাংলাদেশে জলবসন্ত দেখা যায়, একসময় গুটিবসন্ত ছিল। এমপক্স আলাদা ধরনের একটি পক্স ভাইরাস। এমপক্সের প্রধান দুইটি ধরন আছে ক্লেড ১ এবং ক্লেড ২। দুইটি ধরনের মধ্যে আবার সাব ডিভিশন এ, বি রয়েছে।
কঙ্গোতে দীর্ঘদিন এমপক্স প্রাদুর্ভাবের কারণ ছিল ক্লেড ১ ভাইরাস আর ইউরোপে ছড়িয়েছে ক্লেড ২ ভাইরাস। ক্লেড ২ ভাইরাসে মৃত্যুহার কম। কিন্তু আফ্রিকায় যেটা ছড়িয়েছিল ক্লেড ১, সেটার মৃত্যুহার বেশি। ক্লেড ১ ধরনটি গুরুতর। এর মৃত্যুহার ১০০ জনের মধ্যে ৪ জন।
এই ভাইরাসগুলো আগে থেকেই ছিল, মাঝখানে কমে গিয়েছিল। সম্প্রতি আবার বাড়তে শুরু করেছে এমপক্স ভাইরাস সংক্রমণ। আফ্রিকার কঙ্গোতেই আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আশপাশের দেশে ছড়িয়েছে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালের পর মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এমপক্স কীভাবে ছড়ায়
এমপক্স ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে বন্যপ্রাণী থেকে, এটি প্রাণীবাহিত রোগ। আগে যারা বন্যপ্রাণী শিকার করতে যেতেন তারা সংক্রমিত হতেন। কিন্তু বর্তমানে এমপক্স ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে। এজন্য ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
যেভাবে ছড়ায়-
১. এমপক্স ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে। এমপক্স সংক্রমিত ব্যক্তিকে র্স্পশ করা, চুমু দেওয়া, যৌন সম্পর্ক থেকে এটি ছড়াতে পারে।
২. সংক্রমিত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের খুব কাছাকাছি থাকলে সংক্রমণ ঝুঁকি থাকে।
৩. এমপক্স আক্রান্ত বন্যপ্রাণী শিকার করা, চামড়া তোলা, মাংস কাটা এমনকি রান্নার সময়, কম তাপে রান্না করা খাবার খেলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী শিকার করা হয় না খুব একটা। কিন্তু এমপক্স আক্রান্ত প্রাণীর কাছাকাছি গেলেও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
৪. এমপক্স সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহার করা পোশাক, তোয়ালে, বিছানার চাদর, যেকোনো ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
৫. সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহার করা ইনজেকশনের সুঁই অন্য কারো শরীরে প্রবেশ করালেও এমপক্স হতে পারে।
৬. সন্তানসম্ভবা নারী এমপক্স আক্রান্ত হলে অনাগত সন্তানও এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
৭. এমপক্স শুকিয়ে যাওয়ার পর ফোসকার আবরণ যদি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকে ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে।
এমপক্সের লক্ষণ
এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে খুব ব্যথা হয়, জলবসন্তের চেয়েও বেশি ব্যথা হয় এমপক্সে। পায়ের সন্ধিস্থল, গলা, বগলের নিচে থাকা লসিকাগ্রন্থি ফুলে যায়, ব্যথা হয়। প্রচণ্ড ব্যথা ও ফুলে যাওয়ার কারণে জ্বর হয়। ত্বকে পানি ভর্তি ফুসকুড়ি বা ফোসকা হয় এবং সেখানে চুলকানি ও ব্যথা হয়।
এমপক্স এমনিতেই চলে যায়। কিন্তু অনেকে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হয়, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
এমপক্সের চিকিৎসা
ডা. বলেন, এমপক্সের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। সরাসরি কোনো ওষুধ নেই এই রোগের। ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। তবে পরীক্ষামূলক কিছু ওষুধ আছে। রোগীকে আইসোলেশনে রেখে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হবে। ফুসকুড়ি বা ফোসকার ব্যথা ও প্রদাহ কমানোর জন্য ব্যথার ওষুধ দিতে হবে, পুষ্টিকর খাবার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখতে হবে। জলবসন্তের রোগীর মতো করেই এমপক্সের রোগীর যত্ন নিতে হবে। রোগীর অবস্থা জটিল হলে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। যেহেতু এমপক্স ছোঁয়াচে তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে ভাইরাস না ছড়ায়।
এমপক্সের চিকিৎসায় গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন কিছুটা পরিবর্তিত করে আফ্রিকায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে সেই ভ্যাকিসন দেওয়া হবে কি না সেটি ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবেন।
এমপক্স প্রতিরোধ
এমপক্স আক্রান্ত হলে সবাইকে তা জানাতে হবে। বিনা প্রয়োজনে যেন কেউ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চিকিৎসক বা অন্য কেউ রোগীর সংস্পর্শে আসলে অবশ্যই গ্লাভস ও মাস্ক পরতে হবে এবং যথাসম্ভব সুরক্ষা নিয়ে রোগীর চিকিৎসা ও সেবা দিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা জিনিসপত্র ও পোশাক ব্যবহার করা যাবে না।
আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। পক্স শুকিয়ে যাওয়ার পর ফুসকুড়ির আবরণ যেন যেখানে সেখানে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাসায় থাকতে হবে। যতদিন শরীরে ফোসকার স্থানে নতুন আবরণ তৈরি না হয় ততদিন পর্যন্ত।
আক্রান্ত ব্যক্তিকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। শরীরে গুটি বা ফুঁসকুড়িগুলো ঢেকে রাখতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শে দেওয়া মলমের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের জন্য এমপক্স কতটা উদ্বেগের
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এমপক্স উদ্বেগের কারণ কতটা তা নির্ভর করে বাংলাদেশের কাছাকাছি দেশগুলোতে সংক্রমণ কেমন। যদি আশপাশের অঞ্চলে এমপক্স ছড়াতে থাকে তাহলে তা দেশের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হবে। বর্তমানে প্রাথমিক ঝুঁকি অবস্থায় সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বিমানবন্দর, নৌ ও স্থল বন্দরে স্ক্রিনিং চালু করতে হবে। এমপক্সের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করতে হবে। এমপক্স আক্রান্ত দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের বিষয়ে আলাদা নজর দিতে হবে। পরে তারা আক্রান্ত হলো কি না সেটা মনিটরিং করতে হবে, লক্ষণ দেখা দিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনে ফোন দিয়ে রোগীকে সে বিষয়ে জানাতে হবে। সারাদেশেই নজরদারি বাড়াতে হবে, হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতি রাখতে হবে যাতে রোগী পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এমপক্স একাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা মোকাবিলার জন্য কোনো একটি দেশের একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে যেহেতু ভাইরাসটি, এটি আরও মিউটেড করে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখন শারীরিক স্পর্শের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে, ভাইরাস মিউটেড হওয়ার কারণে দেখা যাবে হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। বিশ্বব্যাপী যত বেশি রোগী কমিয়ে রাখা যাবে বা রোগীদের আইসোলেট করে রাখা যাবে, ভাইরাসের মিউটেশন ক্ষমতা তত কমবে। ভাইরাস শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পাবে না। ভাইরাস যত বেশি ছড়ায় ঠিক তত বেশি মিউটেশনের সুযোগ পায় এবং প্রাণঘাতী হয়। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই কেবল এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। সূত্র এফবি।