হাইড্রোজেনে উড়বে বিমান, বদলে যাচ্ছে বিমান শিল্প।

স্টাফ রিপোর্টার
0

 


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, দৈনিক সারা দুনিয়া।


প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হয়, তার প্রায় ৩ শতাংশের জন্য দায়ী আকাশপথে বিমানের চলাচল। শতকরা হিসেবে সংখ্যাটা ছোট হলেও মোট পরিমাণ কিন্তু অনেক বড়।


 এই নির্গত সামান্য ৩ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন মেট্রিক টন। এত বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস—বিশেষ করে কার্বন ডাই-অক্সাইড—অনেক দেশের মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের চেয়েও বেশি।


গড়ে একটি প্লেন প্রতি মাইল উড়তে প্রায় ২৪ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। একটি বাসের মাইল প্রতি কার্বন নিঃসরণের ১০০ গুণ এটি। প্রতিবছর নির্গত এই বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস আমাদের প্রকৃতি ও বৈশ্বিক জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।


 এর ফলে বহু দিন ধরেই এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি বা বিমান চলাচল শিল্প জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প খুঁজে চলেছে।


বিমানের জ্বালানি হিসেবে বেশ কিছু বিকল্প নিয়ে কাজও হয়েছে অনেক। এগুলোর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বিমান-চালিকা প্রযুক্তি হলো হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল। 


গত কয়েক দশকে হাইড্রোজেন কাজে লাগিয়ে বহুবার বিমান ওড়ানোর চেষ্টা করা হলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন ফলপ্রসু হয়নি। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল নিয়ে একটি বিমান ওড়ানোর চেষ্টা করা হয়। তবে এতে বেশ কিছু জটিলতা দেখা যায়।


এর ধারাবাহিকতায় ২০২৩-এর শুরুর দিকে আকাশপথে পরিচালিত হয় পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোজেন-চালিত বিমানের সফল একটি ফ্লাইট। পরীক্ষামূলক এই ফ্লাইট পরিচালনা করে জিরোএভিয়া (ZeroAvia) নামের একটি হাইড্রোজেন-ইলেকট্রিক বিমান নির্মাতা কোম্পানি। 


জিরোএভিয়া-র বানানো ১৯ সিটের বিমানটি যুক্তরাজ্যের কটসঅল্ড এয়ারপোর্ট থেকে ১০ মিনিটের একটি টেস্ট ফ্লাইট পরিচালনা করে। এতে একটি কেরোসিন-চালিত ইঞ্জিনের পাশাপাশি হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের একটি ইঞ্জিনও ব্যবহৃত হয়।


জিরোএভিয়া ছাড়াও গত বছর আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি হাইড্রোজেন চালিত বিমান উড্ডয়নে সফল হয়েছে। জিরোএভিয়ার পরীক্ষামূলক ফ্লাইটের কয়েক মাস পর ইউনিভার্সাল হাইড্রোজেন (Universal Hydrogen) নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল দিয়ে প্রায় ১৫ মিনিটের একটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনা করে। 


‘লাইটনিং ম্যাকক্লিন’-নামের হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল-চালিত বিমান দিয়ে তারা এ পরীক্ষা চালায়। তবে এতেও দুটি ইঞ্জিনের কেবল একটি ছিল হাইড্রোজেন-চালিত।


জিরোএভিয়া ও ইউনিভার্সাল হাইড্রোজেনের প্লেনগুলো হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে ইঞ্জিন পরিচালনা করে। ফলে, এ ধরনের হাইড্রোজেন-ইলেকট্রিক ইঞ্জিনগুলো কেবল স্বল্প দূরত্বের ফ্লাইটে ব্যবহারোপযোগী।


তবে গত বছরের শেষার্ধে এইচ২ফ্লাই (H2Fly) নামে এক জার্মান কোম্পানি সম্পূর্ণ হাইড্রোজেন-নির্ভরশীল এইচওয়াই৪ (HY4) বিমান নিয়ে বেশ কয়েকটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনা করে। 


এর মধ্যে একটি ফ্লাইট তিন ঘন্টারও বেশি সময় ধরে হাইড্রোজেন ইলেকট্রিক সিস্টেমের সাহায্যে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় ছিল।


এটা সম্ভব হয়েছে এইচওয়াই৪ বিমানে হাইড্রোজেন গ্যাসের বদলে তরল হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে।


 গ্যাস ও তরল—দুই অবস্থাতেই প্রায় একইভাবে হাইড্রোজেন-ইলেকট্রিক সিস্টেম হাইড্রোজেন থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, যা বিমানের প্রোপেলারে ঘূর্ণন শক্তির যোগান দেয়। তবে তরল হাইড্রোজেন, গ্যাসীয় হাইড্রোজেন থেকে ৮০ শতাংশ কম জায়গা নেয় ফুয়েল ট্যাঙ্কে। এ কারণে লিকুইড হাইড্রোজেন-ইলেকট্রিক সিস্টেম অনেক দূরের পথও অতিক্রম করতে পারে।


ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন ক্লিন ট্রান্সপোর্টেশন (ICCT)-এর তথ্য মতে, প্রোপেলারযুক্ত বিমানে এরকম লিকুইড বা তরল হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ব্যবহার করা গেলে বিমান চলাচলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রায় ৯০ ভাগ কমে আসবে। তা ছাড়া এসব বিমানে ক্ষতিকারক নাইট্রোজেন অক্সাইড বা অন্য কোনো বিষাক্ত বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত) উৎপন্ন হবে না। কেননা হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের একমাত্র বাইপ্রোডাক্ট হলো পানি।


এসব কারণে জিরোএভিয়া ও ইউনিভার্সাল হাইড্রোজেন আগামী বছরের মধ্যেই হাইড্রোজেন চালিত কমার্শিয়াল ফ্লাইট চালু করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি কোম্পানি দুটি তাদের বিমানে গ্যাসীয় হাইড্রোজেনের বদলে তরল হাইড্রোজেন ব্যবহারের চিন্তাও করছে।


বোয়িং (Boeing) ও এয়ারবাসের (Airbus) মতো বড় বড় বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও তাদের বৃহদাকার কমার্শিয়াল বিমানের জন্য হাইড্রোজেন ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করছে। এয়ারবাস ইতিমধ্যে কয়েকটি হাইড্রোজেন চালিত বিমানের কনসেপ্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছে। বিমানগুলোর নাম তারা দিয়েছে টারবোপ্রপ (Turboprop), টারবোফ্যান (Turbofan), ব্লেন্ডেড-উইং বডি (Blended-Wing Body) ইত্যাদি। 


এই বিমানগুলো ১০০-২০০ যাত্রী নিয়ে এক থেকে দুই হাজার নটিক্যাল মাইল পাড়ি দিতে পারবে হাইব্রিড-হাইড্রোজেন ইঞ্জিনের সাহায্যে।


আপাতত স্বল্প দূরত্বের ছোট-ছোট ফ্লাইটে ও আংশিক রূপে বিমানগুলোতে জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহার হলেও খুব শিগগিরই হাইড্রোজেন চালিত বিমানই হবে এভিয়েশনের ভবিষ্যৎ। 


কমে আসবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ও গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে এভিয়েশন শিল্পের ভূমিকা। এসবই সম্ভব হবে গত বছরের সেই দশ মিনিটের সফল টেস্ট ফ্লাইটের কারণে! ব্যবস্থাপক, ডেফ্টাইল্ড।সূত্র: হাইড্রোজেন ইনসাইট এবং এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ।


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)