পরেশ দেবনাথ, কেশবপুর, যশোর, দৈনিক সারা দুনিয়া।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর, সাবেক এমএনএ প্রয়াত সুবোধ মিত্র-এর ১৭’তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বালিয়াডাঙ্গায় তাঁর সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, ধর্মীয় উপাসনা, স্মরণসভা ও গণভোগ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি কেশবপুর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে ১৯২৮ সালের ১২ মার্চ জন্মগ্রহন করেছিলেন। ২০০৭ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি কেশবপুর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর জেলা পরিষদের অর্থায়নে পৌরসভার বালিয়াডাঙ্গা মৌজায় প্রয়াত সুবোধ মিত্র-এর সহধর্মিণী-এর দানকৃত ২০ শতক জমির উপর যশোর-৬ কেশবপুরের সংসদ জনাব ইসমাত আরা সাদেক সুবোধ মিত্র মেমোবিয়াল অটিজম ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়-এর নব-নির্মিত ভবনের শুভ উদ্বোধন করেন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই গুণি মানুষের মৃত্যুবার্ষিকী পালনে সুবোধ মিত্র কল্যাণ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
এ উপলক্ষে শণিবার (২০ জানুয়ারি) দুপুরে উপজেলার বালিয়াডাঙ্গায় তাঁর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সুবোধ মিত্র মেমোরিয়াল অটিজম ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে স্মরণসভা এবং প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের সভাপতি শিক্ষক ওয়াজেদ আলীর সভাপতিত্বে ও প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলামের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন, সুবোধ মিত্র কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব প্রয়াত সুবোধ মিত্রের একমাত্র পূত্র এ্যাড. মিলন মিত্র। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কেশবপুর উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এস আর সাঈদ, প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম, পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগনেতা আবুল বাসার খান, পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান, মোকাম আলী, যুবলীগনেতা তরিকুল ইসলাম প্রমুখ।
সুবোধ মিত্র কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব প্রয়াত সুবোধ মিত্রের একমাত্র পূত্র এ্যাড. মিলন মিত্র ও তাঁর ইতিহাসসূত্রে জানা যয, অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই গুণি মানুষটি ১৯৪২ সালে বনগাঁ হাই স্কুলের ৭ম শ্রেণীতে পড়াকালীন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে বনগাঁয়ে ছাত্র মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেফতার হন এবং একদিনের জন্য কারাবরণের শিকার হন। ১৯৪৫ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি যশোর জেলা কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটিতে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে রেড কার্ডপ্রাপ্ত সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে বনগাঁ মহকুমা ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রথম কংগ্রেসের কমিটি গঠিত হলে তিনি সে কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী মুসলীমলীগ থেকে আওয়ামীলীগ হওয়ার পর সুবোধ মিত্র দেশ ও জনগণের কল্যাণে আওয়ামীলীগে যোগাযোগ করেন। ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সফরে যশোরে আসলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে কেশবপুরের সন্তান সুবোধ মিত্রের পরিচয় হয়। একই বছর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে সুবোধ মিত্র এক দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে সকলের নজরে আসেন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক পরবর্তীতে সহ-সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলে তিনি আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন জনসভায় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনে সুবোধ মিত্র এই যশোর নির্বাচনী কেন্দ্র আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন এবং ৪৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে এম.এন.এ নির্বাচিত হন। ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে সুবোধ মিত্র উপস্থিত ছিলেন। কেশবপুরের এ রাজনৈতিক জগতের আদর্শ মানুষটির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আপামর জনসাধারণের প্রাণের কথা বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন, জনগণের প্রতি ভালোবাসা দুঃখহীন মানুষের পাশে দাঁড়াবার বাসনা দলীয় কমান্ডের নির্দেশ ও আদেশ, সহনশীলতা একান্ত আনুগত্যতা বিনয়ী ব্যবহার ইত্যাদির কারণে অতি অল্প সময়ে তিনি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত বিশ্বাসী ও হূদয়ের মানুষ হয়ে উঠে ছিলেন। সে কারণে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তৎকালীন ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) জনসভায় বঙ্গবন্ধুর পাশে সুবোধ মিত্রও ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কলকাতা, দিল্লী, মিরাট, নেপালসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে একজন আদর্শ সংগঠক হিসেবে ছুটে বেড়িয়েছেন। দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে অটল বিহারী বাজপেয়ী, সুভদ্রা ঘোশী, ভারত সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক ডিরেকটর জেনারেল মি. বিডি, নেপালের রাজা মহেন্দ্রসহ তত্বকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বহু মানুষের সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। তাঁর মৃত্যু হওয়ায় কেশবপুর এক মহান ব্যক্তিকে হারিয়েছে।