অবশেষে স্রোত তুরস্কের দিকে ঘুরছে? প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তুরস্কে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা আরও প্রকট হবে। কিন্তু এ দফায় তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মাথায় আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডিস তুরস্কের ঋণমান বাড়িয়ে দিয়েছে।
এবারের মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এরদোয়ান তুরস্কের অর্থনীতির দায়িত্ব দেন নতুন একদল অর্থনীতিবিদের ওপর। গত কয়েক বছরের আর্থিক নীতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রথাগত মুদ্রানীতি ফের চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করেন। তুরস্কের অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক ফল এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। ১৮ মাসের মধ্যে জুন মাসে প্রথম চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত বেড়েছে। এর মানে হলো, তুরস্কে যত অর্থ এসেছে, তার থেকে কম অর্থ তুরস্ক থেকে বের হয়েছে।
এরই মধ্যে তুরস্কের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হতে শুরু করেছেন। সুতরাং প্রশ্ন হলো, তুরস্কে কী ঘটতে চলেছে?
মে মাসের নির্বাচনে জনমত জরিপের বিপরীতে এরদোয়ান যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি তাঁর মেয়াদ প্রায় ২০ বছর পার করেছেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এবারের পাঁচ বছরই তাঁর শেষ মেয়াদ হতে পারে। যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এরদোয়ান নিজেই তৈরি করেছেন, সেটিই এখন তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরদোয়ানের অর্থনৈতিক নীতি বা ‘এরদোয়ানোমিকস’ দুটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথমটি হলো, অরক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি। এতে মূল্যস্ফীতি শুধু উসকে দিয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, জোর করে সুদহার যতটা সম্ভব নিচুতে ধরে রাখা।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এখন ভিন্ন পথ নিয়েছেন। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার মেহমেত সিমসেককে। ২০০৭-২০১৮ সাল পর্যন্ত তুরস্কের অর্থনীতির সংযমী ব্যবস্থাপনার জন্য সিমসেক সুনাম অর্জন করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিত মিলেছিল যে তুরস্ক যৌক্তিক অর্থনৈতিক নীতিতে ফিরতে চলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের মধ্যে যাঁরা এরদোয়ানের অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নে সম্মত হননি, তাঁদের পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল নাসি আগবালের অপসারণ। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র চার মাসের মাথায় তাঁকে গভর্নরের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গভর্নর হন সাহাপ কাভসিওগলু। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দলের সাবেক সংসদ সদস্য সাহাপ কাভসিওগলু এরদোয়ানপন্থী সংবাদপত্রে এরদোয়ানোমিকস নিয়ে কলাম লিখতে শুরু করেন। তুরস্কে যখন মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশের কাছাকাছি, সে সময় তিনি আগ্রাসীভাবে সুদহার কমান।
সরকারি হিসাবেই তুরস্কে মূল্যস্ফীতি ৮০ শতাংশের ওপরে ওঠে এবং দেশটির মুদ্রা লিরার মান কমে তলানিতে পৌঁছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার বিক্রি করে লিরার মান ধরে রাখতে চেষ্টা করা হয়। এতে এ বছরের জানুয়ারি মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণে পৌঁছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ভূমিকম্প হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও শোচনীয় অবস্থায় পৌছে।
নতুন পদক্ষেপ
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এখন ভিন্ন পথ নিয়েছেন। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার মেহমেত সিমসেককে। ২০০৭-২০১৮ সাল পর্যন্ত তুরস্কের অর্থনীতির সংযমী ব্যবস্থাপনার জন্য সিমসেক সুনাম অর্জন করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিত মিলেছিল যে তুরস্ক যৌক্তিক অর্থনৈতিক নীতিতে ফিরতে চলেছে।
এবার এরদোয়ান তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হাফিজে গায়ে এরকানকে গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেন। হাফিজে গায়ে এরকান তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম নারী গভর্নর। করপোরেট জগতে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এরকান বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসে মহাপরিচালক ও যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের সহ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর না–ও থাকলে, তার পরও তাঁর নিয়োগকে তুরস্কের বাজার স্বাগত জানায়।
গত ২২ জুন এরকান সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে একলাফে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেন। এক বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। বিবৃতিতে তিনি স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেন যে মূল্যস্ফীতি কমানোর পথ এটিই।
এরপরও লিরার দরপতন অব্যাহত থাকে এবং জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৮ শতাংশে গিয়ে পৌছে। কিন্তু আরও কিছু খাতের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকায় লিরাকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কম চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসাবে আরেকজন দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অর্থনীতিবিদকে নিয়োগ দেওয়া হলে বাজারে নতুন করে আস্থা তৈরি হয়। এরপর ২০ জুলাই তুরস্কে সুদহার আরেক দফা বাড়িয়ে সাড়ে ১৭ শতাংশ করা হয়।
সুদহার বাড়ানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। শতকরা হিসাবে বিশ্বে বেশি জম্বি ফার্ম (যাদের আয় ও ব্যয় সমান এ রকম প্রতিষ্ঠান) রয়েছে। নিম্ন সুদহারের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে। সুদহার বাড়ার কারণে সেগুলো দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে এ শিক্ষাও আছে যে সুদহার বাড়লে ব্যাংকিং খাতে কতটা চাপ তৈরি হয়।
তুরস্কে ব্যাংকিং খাত এরদোয়ানের আমলে নতুন করে গড়ে ওঠেনি। অর্থনৈতিক ঝড়ঝাপটা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার মতো সুদক্ষ ব্যবস্থাপক ও ঝুঁকি মোকাবিলার অভিজ্ঞতা তুরস্কের ব্যাংক খাতে রয়েছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে এরদোয়ানোমিকস বা এরদোয়ানের অর্থনীতিবিষয়ক ভাবনা কি সত্যি সত্যি শেষ হচ্ছে, নাকি সাময়িক বিরতি ঘটেছে?
জেমস সোনার ব্যাঙ্গর ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলসের ডক্টরাল গবেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত